“শোকীয় ভ্রমণ”
১০ই মে। বাড়িতে যাওয়ার জন্য ঢাকার আনন্দ ছেড়েছুড়ে রওয়ানা দিলাম।
বাসস্টপ যাব। রিকশা দরকার।
- ওই মামা যাবেন?
- হ যামু। কই যাইবেন?
- জনপথ মোড়। কত দিব?
- ৩০ টাকা দিয়েন।
- না মামা ২০ টাকা দিব। গেলে চলেন।
- ২০ টাকা দিলে তো অয় না মামা। কি আর করার! চলেন।
পকেটে টাকার সঙ্কট স্টুডেন্টদের জন্য ইউনিভার্সাল ট্রুথ। আমার জন্য সেটা একটু বেশিই ছিল ওইরাতে। বিভিন্ন ঝামেলার পেট ভরাতে গিয়ে আমার পকেট শুন্য হয়েছে। তাও একেবারে কাঁটায় কাঁটায় হিসেব করে বাসা থেকে বের হলাম।
রিকশা চলছে। আমি বাকি রাতটা কিভাবে কাটাবো তার প্লান করছি। রিকশাওয়ালা আমার অমনোযোগিতার সুযোগ নিয়ে কোন দিকে যাচ্ছে তা আল্লাহ আর রিকশাওয়ালাই জানেন।
রিকশা যখন থামল তখন ৮:০৩ মিনিট। আটটায় আমার বাস তবে বিশেষ একজন বলল যে সাড়ে আটটার আগে ছাড়বে না।
যাহোক, কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলল যে “সোজা রাস্তা ধরে পুলিশ ফাঁড়ির কাছে যান। ওখানে গেলেই বাস পাবেন।”
হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। যেতে যেতে প্রায় ০৮:১৫। গিয়ে সাড়ে আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম কিন্তু বাসের টিকিটিও খুঁজে পাচ্ছি না।
শেষমেষ ফোন দিলাম কাউন্টারে।
ওমা একী!! তারা যা বলল তাতে আমার মাথায় রক্ত-মাংস-হাড্ডি সব উঠতে লাগল।
বাস নাকি পোস্তগোলা ছাড়িয়ে গিয়েছে। আর আমাকে নাকি মাওয়া গিয়ে বাস ধরতে হবে!
মস্তিষ্ক ফ্রিজের ভেতর ঢুকিয়ে ঠান্ডা করলাম। কাউন্টারে গিয়ে ওনাদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করতে বললাম। তারা একটা বাসে মাওয়া যাবার ব্যবস্থা করে দিল। অবশ্যই ভাড়া দিতে হবে।
কি সুন্দর ব্যবস্থা!!
মাওয়া পর্যন্ত টেনশনের হাত-পা ধরে গেলাম। ভাড়া দিলাম আশি টাকা।
বিশ টাকা ফেরত নেবার সময় সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলাম,
- আংকেল, মাওয়া গিয়ে কি বাস ধরতে পারব? আপনার কি মনে হয়?
তিনি রক্তচক্ষু দেখিয়ে বললেন,
- ওই মিয়া! কোন প্রশ্ন করবা না। তোমারে মানবতার খাতিরে উঠাইছি। নইলে ওই মাদার** এর কথায় তোমারে উঠাইছি মনে করো?? কোন প্রশ্ন করবা না...
আমার ফিলিংসটা তখন-"চৌধুরী সাহেব! আমাকে চো*না বানাইলেন ক্যান? আমি কি করসি!!!"
মাওয়া পৌঁছে আমার গাড়ির সুপারভাইজারকে ফোন দিলাম। জানলাম তারা নাকি ইতোমধ্যে নদীর মাঝে চলে গিয়েছে। রাতে লঞ্চ নাকি চলাচলও করে না। নইলে ধরতে পারার একটা সুযোগ থাকত।
সুতরাং পরবর্তী স্টেপ ঢাকা ফিরে যাব নাকি ফেরীতে করে ওপারে যাব তার সিদ্ধান্ত। ফেরীতেই যাব ঠিক করলাম। ভাড়া চাইল ত্রিশ টাকা। আমার বের করা টাকাগুলো দেখে কালেক্টর জিজ্ঞেস করল,
- মামার কাছে কি টাকা কম আছে নাকি?
আমি মৃদু অবাক হয়ে দুঃখের সুরে বললাম,
- হ্যাঁ মামা।
- আচ্ছা তাইলে বিশ টাকা রাখলাম।
- আচ্ছা মামা। থ্যাংকস।
বলে মুচকি হাসি দিয়ে ফেরীর রেস্টরুমে উঠে বসলাম। পকেটের সব টাকা বের করে গোনা শুরু করলাম।
১৭৬ টাকা হলো।
মাওয়া থেকে বরিশাল পর্যন্ত যাবার ভাড়াও সর্বনিম্ন ২০০ টাকা। তাও রাতে লোকাল বাস বন্ধ থাকার সম্ভাবনা একশতে ৯৯.৯৯।
এরপরেও বুকে সাহস নিয়ে সর্বশক্তিমানের ওপরে পূর্ণ আস্থা নিয়ে ১৫ টাকার একটা পানির বোতল ২০ টাকা দিয়ে কিনলাম।
ক্ষুধা লেগেছে। যেটা আমার সচরাচর লাগে না। কিন্তু পকেটের অবস্থা বিবেচনাপূর্বক কিছুই কিনলাম না খাবার জন্য।
ফেরী ছাড়ল ৯:৪০ এ। ওপারে যেতে প্রায় দু-ঘন্টার মত লাগবে। বেশী লাগলেও করার কিছু নেই। বসে থাকা আর হাঁটা ব্যতীত সময় পার করা যাবেনা। যতগুলো বাস দেখলাম তার মধ্যে মাত্র দুটি বরিশাল যাবে। একটি সাকুরা। ওটাতে জিজ্ঞেস করতেই ভাড়া চাইল ৩৫০ টাকা।
চুপচাপ সরে এলাম। প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যখন পকেটের এমাউন্টকে অতিক্রম করে তখন সেটাকে বলে "ফইন্নি সিচুয়েশান"। এ মুহূর্তে পুরো ফেরীতে আমিই একমাত্র ফইন্নি যাকে কেউ ফইন্নি বলে মনে করতে রাজি হবে না।
অনেক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনলাম। সময়ও কাটছে না আর আল্লাহও কোন ব্যবস্থা করছেন না।
এক ভাইয়াকে ফোন দিলাম এই ভেবে যে তার কাছ থেকে এমার্জেন্সী কিছু টাকা আনা যায় কিনা। আমার আবার বিকাশ নেই।
জনগণ আবার বিকাশ ব্যতীত টাকার লেনদেন করেন না। ভাইয়া ফোন ব্যক করলেন না। ব্যস্ত সম্ভবত।
একা একা আকাশের দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম,
"আমি আর কিসসুটি করব না। যা করার করো। সমস্যা নাই।"
সাকুরা ব্যতীত দ্বিতীয় গাড়িটি বরগুনা যাবে। আমার নানা বাড়ির এলাকা। ওই বাসের কাছে যেতেই কন্ট্রাক্টর জিজ্ঞেস করলেন,
- কই যাবেন ভাই?
- এটা কি বেতাগী যাবে?
- না ভাই। সুবিদখালী হইয়া বড়গুনা যাইব।
-ওহহ...আচ্ছা বরিশাল যাবে তো তাইনা?
- হ্যাঁ যাবে ভাই। আপনি কোথায় যাবেন খুইলা বলেন তো!
- আসলে ভাই আমি কাঁঠালিয়া যাব। টিকেট কেটেছিলাম। কিন্তু ওরা আমায় রেখেই চলে গিয়েছে। এখন আমি কিভাবে যাব বুঝতে পারছিনা।
- কোন গাড়িতে কাটছিলেন?
- আজমীর পরিবহন
- কই দেখি টিকেটটা...
ভদ্রলোক টিকেট দেখে আমায় বললেন,
- আপনার কাছে কত টাকা আছে বলুন তো! সত্যি সত্যি বলবেন।
এমনতর প্রশ্নে অবাক হলাম। যেন উনি আমার চেহারা দেখেই আমার ফইন্নি মার্কা সিচুয়েশান বুঝে গেছেন। ইতস্তত করে বললাম,
- দেড়শ টাকার মত আছে ভাই। আমার বরিশালে গেলেই হবে। বরিশালের ভাড়া কত রাখতে পারবেন?
- বরিশাল দুইশ টাকা ভাই। তবে আপনার একটাকাও দেয়া লাগবেনা। বিপদে পড়ছেন, আপনারে হেল্প করাটা আমার কর্তব্য। চলার পথে আমরা কত মাইনষেরই তো হেল্প করি, কিন্তু কেউই মনে রাখে না। আপনি বরিশাল যান। বাসায় গিয়া আমার টাকাটা বিকাশ করে দিবেন। না দিলে ভাই এইটা আমার বেতন দিয়া যাইব, আর কিছুনা।
লোকটা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে তার গাড়ীর হেলপারকে ডেকে আমায় দেখিয়ে দিলেন। আর আমি একটু দূরে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,
“থ্যাংক ইউ। ব্যাবস্থা তো ভালই করলা।”
যাবার ব্যবস্থা হয়ে যেতেই চিন্তা করলাম এবার কিছু খাওয়া দরকার। দশ টাকার নারিকেল-চিড়া কিনলাম। যেভাবে মুখে দিচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল ক্ষুধার সাথে আমার ফাইটিং চলছে। খেয়ে বোতলের পানি পূরোটা শেষ করলাম। ‘ঝামেলা মুক্তি দিবস’ পালন করতে গান শোনা যেতেই পারে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গান শুনলাম। তারপরে লন্ডনফেরত এক বাংলাদেশীর সাথে পরিচয়পূর্বক কথা হল।
কাওড়াকান্দী পৌঁছে গাড়িতে উঠলাম। বক্স এ বসা ছাড়া উপায় নেই, পুরো গাড়ি ভরপুর। বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ লাফিয়ে উঠলাম পায়ে ছ্যাঁকা লাগল বলে। খেয়াল করে দেখলাম যেখানে বসেছি তার নিচের স্টীলের পাতটা ইঞ্জিনের গরমে ছ্যাঁকা দেবার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে। অনেক মেয়েরা যেমন থাকে। এবং সফলও হোল। প্রায় তিন-চারবার পায়ে লাগল আর চক্ষু বন্ধ করে সয়ে গেলাম।
বরিশাল যখন নেমেছি তখন রাত তিনটা বেজে দশ মিনিট। দুয়েকটা গ্যারেজ ব্যতীত আর কিছুই খোলা নেই। বন্ধু, ভাই কেউই এত রাতে আমার জন্য গেট খোলার মহান দায়িত্ব নিবেনা। তাই ঠান্ডা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে ব্রজমোহন কলেজের মসজিদের দিকে চললাম। কারণ, ওটার বারান্দা সর্বোদাই খোলা থাকে এবং কলেজের ভেতরে হওয়াতে মোটামুটি সিকিউরড।
গেটের কাছাকাছি যাওয়াতেই দেখি দারোয়ান সাহেব বসা। মানুষ না কুকুর দারোয়ান। বিনা বেতনে রাত তিনটার সময় কোন বাঙালী দারোয়ানই সজাগ থাকবে কিনা সন্দেহ। যাহোক এটিচুড দেখায়ে তার কাছ থেকে পার পেলাম। ব্যাগটা বারান্দায় রেখে ফ্রেশ হলাম। পেটের ক্ষুধা এখন আর নাই। তাই কয়েক আঁজলা পানি পান করে গেলাম দেখি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকা যায় কিনা। শোয়া তো দূরে থাক বারান্দায় বসা মাত্রই লক্ষ-কোটি মশারা এসে আমায় ঘিরে ধরল।
যেন অভুক্ত কিছু জম্বির কবলে পরেছি আমি। ফলাফল, ঘুমহীন আরেকটা রাত কাটাতে হবে। সাড়ে তিনটা বাজে। চারটার আগে ফজরের আজানও দিবে না। নিষ্কর্ম বসে না থেকে আল্লাহর নাম নেয়াটাই শ্রেয় মনে হল তখন। আল্লাহর নাম বসে থেকেও নেয়া যাবেনা। জম্বি রয়েছে তাহলে। তাই বারান্দার পাঁচটা লাইন ধরে হেঁটে গেলাম আবার আসলাম। এভাবে চলতে থাকল। কিন্তু সময় যেন ফুরোচ্ছে না। হাঁটতে আমার ক্লান্তি নেই।
মসজিদের মুয়াজ্জিন আমায় নোটিস করছিলেন অনেক্ষণ ধরে। বারান্দার লাইন ধরে হাঁটতে দেখে পাগল-টাগল ভাবলেও দোষ দিব না। যাহোক ফজরের নামাজের পরে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে জনৈক বন্ধুর রুমে গেলাম। সকাল আটটায় ঘুম শুরু করলাম। বারোটা পর্যন্ত চলল। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হবার পরে বুঝতে পারলাম যে আমার শোকপূর্ণ ভ্রমণের রাতটা ভালই কাটল।
দ্রষ্টব্যঃ
১) পকেটে টাকা না থাকলেও যেকোন জায়গা থেকে ঘুরে আসা যায়। দরকার শুধু বুদ্ধি আর ভাগ্যের।
২) নারিকেল-চিড়া যেমন স্বাদ তেমনি উপকারী। একবার খেলে আর সারারাতে ক্ষুধা লাগবে না।
৩) ছ্যাঁকা খেতে প্রেম করতে হয় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন